আমার মা: আলহাজ্ব তোফায়েল আহমেদ
ভোলা প্রতিনিধিঃআজ মায়ের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬-এর ২৫ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে সবার মায়া ত্যাগ করে তিনি এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানের কাছে মা পরমারাধ্য। আমার জীবনেও মা প্রিয় মানুষ, শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মায়ের স্নেহ-আদরে বড় হয়েছি। মায়ের পবিত্র মুখখানি যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মনে হয় এখনই মায়ের কাছে ছুটে যাই।
জন্ম থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মা যত্ন করে আমায় গড়ে তুলেছেন; মা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না। শৈশব আর কৈশোরের সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে দু’চোখ ভিজে আসে।
প্রতিবার নির্বাচনী জনসংযোগে যাওয়ার প্রাক্কালে কাছে টেনে পরমাদরে কপালে চুমু খেয়ে সার্বিক সাফল্য কামনায় প্রাণভরে দোয়া করতেন মা। মমতাময়ী মায়ের কোমল স্মৃতি খুব মনে পড়ে।
আমার বাবা ১৯৭০-এর ২৫ এপ্রিল ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ে। বাবার মৃত্যু সংবাদ আমার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন।
তিনি চট্টগ্রামে আমাদের প্রিয় নেতা এমএ আজিজকে জানিয়েছিলেন, ‘তোফায়েলের বাবা মৃত্যুবরণ করেছে।’ সভা শেষে চাঁদপুর হয়ে ২৬ এপ্রিল সকালে গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই।
ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হয় ’৭০-এর ১৭ এপ্রিল। প্রতিবছর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে তাদের স্মরণ করি। কিন্তু এবার করোনা মহামারীর কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
সেই ছোট্টকালেই যখন আমার বয়স মাত্র ১৩, তখন আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। কষ্ট হলেও মা আমাকে আদর করে লেখাপড়ায় নিয়মিত উৎসাহ জোগাতেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মোট চৌদ্দটি বছর হোস্টেলে ছিলাম।
মা আমাকে আদর করে ‘মনু’ বলে ডাকতেন। সবসময় বলতেন, ‘মনু, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো।’ মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। মাকে ছেড়ে জীবনের প্রথম হোস্টেলজীবন। মন পড়ে থাকত মায়ের কাছে। অপেক্ষায় থাকতাম কখন মায়ের কাছে যাব। প্রতি সপ্তাহে ছুটির আগের দিন মায়ের কাছে চলে যেতাম।
১৯৬০-এ ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে-এটি বেদনাদায়ক। তখন ছোট্ট একতলা কাঠের লঞ্চে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে ২৪ ঘণ্টা লাগত। সে জন্য ঢাকা কলেজ ছেড়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হই। কলেজ থেকে সাপ্তাহিক ছুটিতে লঞ্চে ভোলায় মায়ের কাছে একদিন থেকে ফিরে আসতাম।
কলেজে ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তারপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি, ডাকসু ভিপি, ছাত্রলীগ সভাপতি। ’৭০-এর ৩ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ভোলা-দৌলতখাঁ-তজুমুদ্দী-মনপুরা আসনে আমাকে মনোনয়ন দেন। মাত্র ২৭ বছর ১ মাস ১৫ দিন বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। মনে পড়ে ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের কথা। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জীবনের প্রথম জনসভা। সেদিন ছিল ‘শপথ দিবস’।
স্লোগান তুলেছিলাম: ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ আমরা সেই শপথ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছি। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে আসাদ-মকবুল-মতিউর-রুস্তম-আলমগীর শহীদ হয়। সেই দিনগুলোয় মা চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাতেন, প্রাণভরে আমার জন্য দোয়া করতেন।
’৭০-এর ১২ নভেম্বরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের প্রাক্কালে ভোলার দাসের হাটে আমার নির্বাচনী জনসভা ছিল। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে যখন রওনা করেছি, তখন মা কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেছিলেন, ‘এ দুর্যোগের মধ্যে তুমি আজ যেয়ো না।’ মায়ের কথা রেখেছিলাম। নয়তো সেদিন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভোলার ৫ লক্ষাধিক লোকের সঙ্গে আমিও মৃত্যুবরণ করতাম।
মা ও মাতৃভূমি আমার কাছে সমার্থক। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের দেরাদুনে মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলতাম: ‘প্রিয় নেতা, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানি না!
যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততদিন মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ সেদিনের সেই শপথও আমরা জীবনবাজি রেখে বাস্তবায়ন করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছি। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে আমি ও রাজ্জাক ভাই ১৮ ডিসেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ২৮ ডিসেম্বর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত মায়ের কোলে ফিরে আসি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দি। ১৫ আগস্টের দু’দিন পর ১৮ আগস্ট আমার বাসভবনে এসে খুনিদের অন্যতম মেজর শাহরিয়ার (যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ (তারও ফাঁসি হয়েছে) বলপ্রয়োগে আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীরের ওপর দিয়েই আমায় টেনে নিয়েছিল ঘাতকের দল। ’৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। আমি তখন কারাগারে। দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয়নি। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগনিজামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থেকেছেন। তিনি এক বছর ছিলেন কলাবাগানে। মা এ বাসায় থেকেছেন এবং সেই কঠিন দিনগুলোয় কষ্টকর জীবনযাপন করেছেন। সে সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সামান্য টাকা ছিল। জিয়াউর রহমান অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছিল। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেয়ার বহুরকম চেষ্টা করেছে। কোনো দুর্নীতি আবিষ্কার করে মামলা দিতে পারেনি। আমার বনানীর বাড়ি-এ বাড়ির জমি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন-’৭৫-এর ৩০ জুলাই বরাদ্দ হয় আমার স্ত্রীর নামে। আমার বড় ভাই ’৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই যখন হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে, মা তখন অসুস্থ। আমাকে বলেছিলেন, মাকে দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি গিয়েছিলাম। মা বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই মায়ের আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার