কর্ণফুলীর এসিল্যান্ড সুকান্ত সাহার ইশারায় লড়ছে সব
কলকাঠি
চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম অনুসন্ধানে দুদক
আব্দুল মতিন চৌধুরী রিপন বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়মের পাহাড় সমতু্ল্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অপরাধ আর অনিয়ম অনুসন্ধানে নতুন করে কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্সের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পে নিয়োজিত এক সার্ভেয়ারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদকের নজরে আসে, সার্ভেয়ারের মর্জিতেই স্থান নির্ধারিত হয় নতুন নতুন প্রকল্পের। এ নিয়ে সুনীল কান্তি দেব মহাজন নামের ওই সার্ভেয়ারের পাশাপাশি প্রকল্পের অনিয়মে জড়িত স্থানীয় দুই পিতা-পুত্রের সংশ্লিষ্ট নথি তলব করেছে দুদক। আর এদের প্রত্যক্ষ সহযোগী এসিল্যান্ড সুকান্ত সাহা। তার যোগসাজসে অডেল টাকার মালিক বনে যান সুনীল কান্তি দেব ও পিতা-পুত্র।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের সর্বশেষ অনুমোদিত উপজেলা কর্ণফুলী। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উপজেলা প্রশাসনের কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ৬ একর জমি অধিগ্রহণের পদক্ষেপ নেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অধিগ্রহণকৃত বেশিরভাগ জমি স্থানীয় আবদুস ছালাম ও তার ছেলে ওয়াসিমের নামে আমমোক্তার ও খরিদকৃত। তারাই জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ চেক গ্রহণ করেছে। এ নিয়ে ২০১৯ সালের শুরুতে একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। ওই অভিযোগে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের (এলএ মামলা নং- ৩০/১৭-১৮) জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থান নির্ধারণ নিয়ে যোগসাজশ ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের সাথে জড়িত সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজন অনিয়ম দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের মালিক বনেছেন। পরবর্তীতে দুদক প্রধান কার্যালয় অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি অভিযোগটির অনুসন্ধানে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমকে প্রধান করে দুই সদস্যের টিম গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানে নেমে দুদক জানতে পারে, কর্ণফুলী উপজেলা কমপ্লেক্স করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যের জমি থাকায় শাহমীরপুর মৌজায় কমপ্লেক্স করার প্রস্তাব হয়। কিন্তু ওই প্রস্তাবের পর এসিল্যান্ড সুকান্ত সাহা'র প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সার্ভেয়ার সুনীলসহ কয়েকজনের যোগসাজশে স্থান পরিবর্তন করা হয়। স্থানীয় আবদুস ছালাম, তার ছেলে ওয়াসিম ও তার মেয়ের জামাই আইয়ুবের নামে আমমোক্তার ও খরিদকৃত স্থানে অধিগ্রহণের স্থান নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া অভিযোগ আছে, ওই এলাকার মিউটিশনের প্রতিটি মামলায় ২০ হাজার টাকা করে নিচ্ছে এসিল্যান্ড সুকান্ত সাহা। সাইফুল নামের চরলক্ষ্যা গ্রামের এক ব্যক্তি জানান, তার একটি খতিয়ান অনুমোদন পেতে দালাল চক্রটিকে দিতে হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার টাকা এসিল্যান্ড সুকান্ত সাহাকে দিয়ে খতিয়ান অনুমোদন নেয়া হয়। তার দাবি অনুযায়ী টাকা না দিলে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে আপত্তি দাখিল করান ওই এসিল্যন্ড।
এদিকে দুদক সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম বক্তব্য জানতে নোটিস দিলেও হাজির হননি আবদুস ছালাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ইউনিয়নের আবদুস ছালামকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বক্তব্য দিতে দুদকে হাজির হননি। পরবর্তীতে আবদুস ছালাম ও তার ছেলে ওয়াসিমের নামে চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ শাখা হতে যতগুলো চেক ইস্যু হয়েছে, সবগুলোর পেমেন্ট নথি চাওয়া হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন থেকে এসব নথি এখনো দেওয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে জানতে চাইলে আবদুস ছালাম বলেন, আমি কিছুই জানি না, আমি বয়স্ক মানুষ। সুনীল বাবু (সার্ভেয়ার) গরীব মানুষ। তার বিরুদ্ধে আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। আমার বিল্ডিংয়ে পুরো উপজেলা। আমাকে তারা (উপজেলা প্রশাসন) ভাড়াও দেয় না।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী উপজেলায় আমার ৮০ কানি সম্পত্তি আছে। অধিগ্রহণে সব আমার জায়গা। আমার বাবা জায়গা কিনেছে, আমার দাদা জায়গা কিনেছে, আমি জায়গা কিনেছি, আমার ছেলেরাও কিনেছে। আমার ছেলেরাও বলতে পারে না, তাদের নামে জায়গা কিনেছি। কানি জমি ৬০ হাজার টাকা যখন ছিল, তখন থেকে কিনছি। এখন গণ্ডা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। অধিগ্রহণ হওয়াতে আমি আরো লোকসানে পড়েছি। কারণ রাস্তার পাশের জায়গা আমি গণ্ডা ২০ লাখ টাকা করে পেতাম। এখন পেয়েছি ১০-১২ লাখ টাকা করে।
ভুক্তভোগী আলী হায়দারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ওর বাবা ওই জায়গা অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বাবা বিক্রি করে দিলে ছেলে তো সম্পত্তি পায় না। ভূমি অফিসের তদন্তেও তার জায়গা পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, আব্দুস ছালামের ভবনে কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কার্যালয় রয়েছে। ওই সুযোগে তিনি স্থানীয় মানুষের জমি জোরপূর্বক দখল করে। নিরহ জনগণ তার প্রভাবে কাছে হার মেনে নিরুপায় হয়ে আবদুস ছালামকে জমির আমমোক্তারনামা দিতে বাধ্য হয়। এসব জমিতে উপজেলার বিভিন্ন ভবন সুকান্ত সাহার মাধ্যমে প্রস্তাবিত দেখিয়ে জমির তিনগুন টাকা হাতিয়ে নেয়।
স্থানীয় সূয়ত্রে জানা যায়, তার বাবা ও দাদার নামে এসব সম্পত্তি দাবি করলেও তাদের নামে কোন সম্পত্তি ছিল না। দশ বছরের ব্যবধানে শত কোটি টাকার মালিক বলে দাবি করছেন তিনি। তিনি ও তার ছেলের বিরুদ্ধে বিদেশে নারী পাচারের অভিযাগ আছে। তার দুই ছেলে ওয়াসিম ও জসিম দুবাই নাইফ রোডের সেন্ট্রাল প্যারিস নামের একটি হোটেলে নারী পাচার করে।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সার্ভেয়ার সুনীল কান্তি দেব মহাজনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ থাকায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। এখনও সব কর্মচারীদের সাথে পরিচয় হয়নি। সার্ভেয়ার সুনীলের বিষয়ে দুদক থেকে কোন নথি চাওয়া হয়েছে কিনা, জানি না।