“গলাধঃকরণ ক্ষমতার চেয়ে কামড় বড় হওয়া উচিত নয়”
অধ্যাপক ড.মীজানুর রহমান
আধুনিক মার্কেটিং শাস্ত্রে পারসনকে(person) পণ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। পণ্যের দশটি অস্তিত্বের একটি হচ্ছে ‘পারসন’ । মানুষকে পণ্য বলতে যাদের সংকোচ ছিল, পন্যের বিভিন্ন নামকরণের মাধ্যমে মানুষকে পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা জায়েজ হয়ে গেছে। পণ্য হচ্ছে সমস্যার ‘সমাধান’। এটাকে বলা হয় ‘টোটাল অফারিং’ । আজকাল বলা হচ্ছে পণ্য হচ্ছে ‘এক্সপেরিয়েন্স’ বা অভিজ্ঞতা। কর্পোরেট ব্র্যান্ড এবং পার্সোনাল ব্র্যান্ডের মধ্যে অনেক দিক থেকেই মিল রয়েছে। পার্সোনাল ব্র্যান্ড হচ্ছে- আপনি কে? আপনার অবস্থান কি? আপনি কী মূল্যবোধ(value) ধারণ করেন? এবং কিভাবে আপনি আপনার মূল্যবোধকে প্রকাশ করেন? কোম্পানি যেমনটি তার প্রতিযোগী কোম্পানির বিপরীতে তার কোম্পানির ভ্যালু পজিশনকে তুলে ধরার জন্য ব্র্যান্ডকে ব্যবহার করে, পার্সোনাল ব্র্যান্ডও ব্যক্তির জন্য একই কাজ করে। পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং ক্লায়েন্টের নিকট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচিতি তুলে ধরতে সাহায্য করে। প্রত্যেক মানুষের নিজের একটা গল্প থাকে; লক্ষ্য, নৈপুণ্য এবং পারিপার্শ্বিকতা থাকে। যার কারনে বলা হয়, “personal branding is one’s story”। সাইবার যুগে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং ‘থাকা ভালো’, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে, এটা এখন ‘প্রত্যাশিত’।
পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং শুরুটা হবে নিজের জন্য একটা কোটর বা কুলুঙ্গি (Niche) খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে। Niche শব্দটি স্থপতিরা এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশি ব্যবহার করেন। Niche হচ্ছে দেয়ালের ওই ফোকর যেখানে চড়ুই পাখি বাসা তৈরি করে। পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের কাজটা শুরু করতে হবে nishemanship থেকে। Nichemanship এর মূলে থাকে বিশেষীকরণ । এমন ক্ষেত্র নির্বাচন করতে হবে যেখানে আপনার বিশেষজ্ঞ যোগ্যতা আপনার পরিমণ্ডলের ৯০ শতাংশ মানুষের চেয়ে বেশি হবে। যদি দেখেন আপনার মধ্যে এমন কোনো যোগ্যতাই নেই, তাহলে আপাতত ব্র্যান্ড হওয়ার দরকার নেই, বাল্ক (bulk) হিসেবেই নিজকে বিক্রির চেষ্টা করুন। বাজারে এখনো বেশিরভাগ পণ্যেই বাল্ক (খোলা সয়াবিন তেল) হিসেবে বিক্রি হয়। এ সময়ে অন্তত একটি বিষয়ে হলেও বিশিষ্টতা অর্জনের চেষ্টা করুন। আপনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, সেটা অন্যকে করতে দিন।
কেউ কেউ মনে করেন বড় পরিসরে ছোট অবস্থানে থাকার চেয়ে, ছোট পরিসরে বড় অবস্থানে থেকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারলে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং সহজ হয়। তাই হয়তো আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যায় অনেকে বড় দলের কর্মী বা ছোট নেতা হওয়ার চেয়ে, ছোট দলের বা নিজের সৃষ্ট দলের বড় নেতা হওয়াকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। রাজনীতিতে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের এটি একটি অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। এ দিয়ে রাজনীতিতে বেশি দূর এগোনো যায় না। তবে এই প্রক্রিয়ায় পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফল অর্জন করা না গেলেও কিছু লক্ষ্য অর্জিত হয়। যেমন ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস ব্যাপক হারে বাড়ে; তবে ‘share of mind’ বাড়লেও ‘share of heart’ বাড়ে না। যার ফলাফল দেখা যায় জাতীয় নির্বাচনে। অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হলেও তাঁদের জামানত থাকে না বা থাকবে না । মান্না , সাকী, নুরু, ইব্রাহিম, রতন, মাহী, পার্থ এ ধরনের ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেসের উদাহরণ। ‘ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেসকে’ ‘ব্র্যান্ড ইকুইটিতে'(ভোটার) পরিণত করার আরো অনেক পথ বাকী থাকে। আর সেই পথ অতটা সহজও নয়। অনেক বেশি লোককে প্রভাবিত করা এবং পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনা যদি রাজনীতি লক্ষ্য হয়, তাহলে বড় দলের ভিতর থেকেই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের কাজটি করতে হবে। যথাযথ ব্র্যান্ডিং করতে পারলে বড় দলেও আপনি প্রভাবশালী (মাস্তান নয়) হয়ে উঠতে পারেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং হচ্ছেন পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হওয়ার অতি নিকটতম সফল উদাহরণ।
নিজের ব্যক্তিত্বকে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করুন। ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দটার ভুল ব্যবহার দেখতে পাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। যেমন আমরা প্রায়ই বলে থাকি, কিছু লোকের ব্যক্তিত্ব নাই এবং এদেরকে ব্যক্তিত্বহীন বলে গালি দেই। আসলে ব্যক্তিত্বহীন কোনো মানুষ হয় না। যে সকল কারণে আমরা কাউকে ব্যক্তিত্বহীন বলছি এইসব কারণগুলোর যোগফলই হচ্ছে ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব। আমেরিকান মনোবিজ্ঞান সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, “personality refers to individual differences in characteristics, patterns of thinking and feeling and behavior”। অর্থাৎ আমি যে আমি, আপনি যে আপনি, আমি যে আপনি না, বা আপনি যে আমি না; এটাই আপনার-আমার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বকে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আপনার নিজের ভিতরের স্বাতন্ত্র্যটি আপনাকে চিহ্নিত করতে হবে, যার কারণে অন্যদের তুলনায় সমাজ আপনাকে আলাদাভাবে দেখে। আপনার কাজ হচ্ছে অন্যদের মনে আপনার স্বাতন্ত্র্য অবস্থানটির কারণ জানা। ধরা যাক, আপনি একজন জনপ্রিয় কবি। ‘ছন্দের বিশুদ্ধতাই’ কবিদের ভিড়ের মধ্যে আপনার এই জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। তাহলে আপনাকে আপনার পরবর্তী কবিতায় ছন্দের উপর আরো বেশি জোর দিতে হবে। এই অবস্থায় Al Ries এবং Jack Trout নিজের বর্তমান অবস্থানটাকে জোরালো করতে পরামর্শ দিয়েছেন ( to strengthen its own current position )। এটাকে ডিফেন্স স্ট্র্যাটিজি হিসেবে বিবেচনা করলেও ক্ষতি নেই । ধরুন, ফুটবল খেলায় আপনার দল ফাস্ট হাফে ২-০ গোলে এগিয়ে
আছে, অর্থাৎ ভালো অবস্থানে আছে এবং এই ভালো অবস্থানের কারণ হচ্ছে- ‘গোল’। এটাকে প্রোটেক্ট করার সবচেয়ে ভাল বুদ্ধি হচ্ছে সেকেন্ড হাফের শুরুতেই আরও গোল করা। এটাকে বলা হয় পজিশন ডিফেন্স (position defense)। ছোটবেলায় ফুটবল খেলার সময় আমরা এই কাজটা করতাম। প্রথম হাফে এগিয়ে থাকলে দ্বিতীয় হাফে ডিফেন্সিভ খেলতাম। এত জোরে হাই কিক দিতাম বল গিয়ে স্কুলের পাশে বাঁশঝাড়ের মাথায় গিয়ে পড়তো। যেহেতু বল একটাই থাকতো (খড়ের গোল্লা অথবা জাম্বুরাকে বাদ দিলে), বল বাঁশঝাড়ের উপর থেকে নামিয়ে আনতে ১০/১২ মিনিট সময় লেগে যেত। এরপর হয়তো আরেকটা কিক মেরে বল পার্শ্ববর্তী পুকুরের মাঝখানে ফেলে দিতাম । এতে দুটি লাভ, একদিকে সময়ক্ষেপন হত এবং অন্যদিকে ভিজে যাওয়ার কারণে বলের ওজন বেড়ে যাওয়ায় বলের গতি কমে যেত। আমাদের সময়ে ফুটবল খেলার কোন নির্দিষ্ট টাইম লিমিট (মিনিট) ছিলো না । আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে ছাত্ররা কেউ ঘড়ি পড়তো না। গ্রামে ছাত্রদের মধ্যে কেউ ঘড়ি বা চশমা পড়লে অনেকেই তাকে “ফুটানি দেখাচ্ছে” বলে ঠাট্টা করত। পড়ন্ত বেলায় শুরু করতাম আর মাগরিবের আজান পর্যন্ত খেলতাম। বর্ষার দিনে ফুটবল খেলা শেষে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ার আগে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদেরকে ভাস্কর্যের মতো দেখা যেত। একমাত্র গোলকিপারই কোন নির্দিষ্ট অবস্থানে অর্থাৎ গোলপোস্টের আশেপাশে থাকত, বাকি সবাই বলের পিছনে দৌড়াতাম। একবার আমাদের স্কুলে পাশের স্কুল থেকে বদলি হয়ে (TC নিয়ে) ‘অমূল্য’ নামে এক ছাত্র আসলো। প্রথম দিনেই অমূল্য ক্লাসে স্যারের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় বলল, ” আমি আমার আগের স্কুলে ফুটবল টিমে সেন্টার ফরওয়ার্ডে খেলতাম”। সম্ভবত নবাগত অমূল্য আমাদের ফুটবল টিমের সেন্টার ফরওয়ার্ডের অবস্থানটা পেতে চেয়েছিল। একথা শুনে আমাদের শ্রেণি শিক্ষক সাধন ভৌমিক স্যার বলেছিলেন, “তোদের আবার সেন্টার ফরওয়ার্ড ! তোরা তো বল যেখানে সবাই সেখানে”।
পুরো মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে গোল দেয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। আপনাকে মাঠে একটা অবস্থান নিতেই হবে। অন্তদর্শন(introspection) পদ্ধতিতে আপনার সফলতা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন- কোন ক্ষেত্রে কাজ করলে আমি অন্যের চেয়ে ভাল করব? আমি কী দ্বারা উদ্বুদ্ধ হই ? কি কারণে অন্যরা আমাকে সৌজন্যে দেখায়? কোন কাজের সময় অন্যরা আমাকে সহযোগিতা করবে? কোন কাজে আমার শক্তির অপচয় হবে? কোন কাজে আমি বেশি সময় দিতে পারবো এবং ক্লান্ত হবোনা ?(Sean Gresh;2017)। আপনি নিজে এ সকল প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে নিশ্চিত না হতে পারলে বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য অথবা সহকর্মীদের সাহায্য নিন। তাঁদেরকে বলুন উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর আলোকে আপনাকে বর্ণনা করতে। যখনই আপনি আপনার ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন তখনই এগুলোকে আপনার পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করবেন। আপনার পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে কেবল আজকের আপনিই প্রতিফলিত হবেন না। আপনি কোথায় যেতে চান তার রোডম্যাপও এতে থাকবে। আপনার বর্তমান সবলতা এবং দুর্বলতার বাইরেও ভবিষ্যতে আপনি যেখানে যেতে চান সেই পথপরিক্রমায় আপনার সফলতা ও দূর্বলতাগুলো বিশ্লেষণ করুন। তাহলেই আপনার আপনি আপনার ইপ্সিত লক্ষ্যে ধাবিত হওয়ার জন্য যে জ্ঞান দরকার তা অর্জন করতে পারবেন। (চলবে)
লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ
Leave a Reply