ব্রেন স্ট্রোক আসলে কী? লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়।
অনেকেই স্ট্রোক আর হার্ট অ্যাটাককে একই বিষয় মনে করেন। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। সারা বিশ্বে প্রতি ৬ জনে ১ জনের ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। বছরে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ ব্রেন স্ট্রোক করেন এবং আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যায়, আর ৩০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সাধারণত ব্রেন স্ট্রোক ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষদের বেশি হয়।
ব্রেন স্ট্রোক কী:
মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হলে বা বন্ধ হলে মস্তিষ্কের কলাগুলো অক্সিজেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান পায় না ফলে ব্রেন স্ট্রোক হয়। ব্রেন স্ট্রোকের কিছুক্ষণের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোষগুলো মরতে শুরু করে।
ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার কারণ :
ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার প্রধান কারণ হল মস্তিষ্কের রক্তের সরবরাহে সমস্যা।
যেমন- ক. ইসেকমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke) মস্তিষ্কে রক্তের সরবরাহ কম হলে।
খ. হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke) মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে।
তিন ধরনের ব্রেন স্ট্রোক হয়ে থাকে:
১) Ischemic stroke
২) Hemorrhagic stroke
৩)(TIAs), Transient ischemic attack বা mini-stroke
১)Ischemic stroke: এ ধরনের স্ট্রোক সাধারণত বেশি হতে দেখা যায় যা প্রায় ৮৫ %। মস্তিষ্কের রক্তনালী সরু হয়ে গিয়ে রক্ত চলাচল বাধা গ্রস্থ হলে এই ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে চর্বী জাতীয় পদার্থ ধ্বমনী বা শিরার ভিতর পৃষ্ঠে পুরু প্রলেপ (plaque) সৃষ্টি করে। আবার বিভিন্ন কারনে জমাট ক্ষুদ্র রক্ত পিন্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে রক্তচলাচলের পথ সরু হয়ে যায়। যে কারনে সংকীর্ণ পথ দিয়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, পুষ্টি উপাদান ও রক্ত চলাচল করতে পারেনা এবং মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের মুত্যু ঘটে ও ব্রেন স্ট্রোক ঘটায়।
২)Hemorrhagic stroke: মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে জমাট বেধে ঐ অংশকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। রক্ত কোষের প্রাচীর দুর্বল হয়ে ফেটে যায় এবং রক্ত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের স্ট্রকের ক্ষেত্রে ৩০-৫০ ভাগ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঘটে।
৩)Transient ischemic attacks বা mini-stroke: এ ধরনের স্টোকে দেহের কিছু অংশে আংশিক ছোট ছোট লক্ষণ দেখা দেয় যা নিকট বর্তী সময়ে বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্বাভাস দেয়। যেমন আংশিক ও সাময়িক অবশতা, ঝিমুনি, দুর্বলতা, কম্পন, স্নায়ুশূল ইত্যাদি। এক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে বড় ধরনের স্ট্রোকের ঝুকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ব্রেন স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ:
হঠাৎ দেহের কোন অংশের অবসতা, দুর্বলতা: মুখমন্ডল, বাহু, পা অথবা দেহের এক পাশের পক্ষাঘাত হওয়া।কথা বুঝতে না পারা, কথায় জড়তা সৃষ্টি হওয়া, ঝিমানি ভাব, দেহের ভারসাম্য হাড়ানো, চোখে অন্ধকার দেখা ।
উপরোক্ত লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা দেয়ার সাথে সাথে ডাক্তার দেখাতে হবে। শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেলে মুখ থেকে মুখে শ্বাস দিতে হবে। বমি হলে মাথা একদিকে কাত করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিছু খাওয়ানো বা পান করানো যাবে না।
ব্রেন স্ট্রোকের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা :
শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ব্রেইনের কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফী (Computerized Tomography scan of brain ) , কারোটিড আল্ট্রাসাউন্ড (Carotid Ultrasound), ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স ইমেজিং (Magnetic resonance imaging), ইকোকারডিওগ্রাফী (Echocardiograph).
স্ট্রোকের ধরন, মাত্রা এবং রুগীর বয়সের উপর এর চিকিৎসা নির্ভর করে। ইসেকমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke)-এর ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে- রুগীকে রক্ত জমাট না হওয়ার ঔষধ সেবন করানো। স্ট্রোকের পরপরই রুগীকে এসপিরিন সেবন করানো। এটি পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমায়।অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করবেন।
ব্রেন স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় :
স্ট্রোক প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল উপায় হল স্ট্রোকের ঝুঁকি সর্ম্পকে জানা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলা।
এই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি হল:
১) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
২) কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা
৩) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
৪) দেহের সঠিক ওজন বজায় রাখা
৫) নিয়মিত ব্যায়াম করা
৬) মানসিক চাপমুক্ত থাকা
৭) ধূমপান থেকে বিরত থাকা
৮) মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা
৯) সুষম খাদ্য গ্রহণ করা। বিশেষ করে শাকসব্জী, দুধ, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খাওয়া। খাসির মাংস, গরুর চর্বী যুক্ত মাংস এড়িয়ে চলুন।
ব্রেন স্ট্রোক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম।
– ডা.মোঃ সাইফুল আলম।
এম.ডি.(রুদেন ইউনিভার্সিটি) মস্কো,রাশিয়া।
Leave a Reply