জাকির হোসেন সুমন সিলেট ব্যুরোঃ
খড়কুটো আর টিন বা ছনের বেড়া দিয়ে নির্মিত ঘরেই তাদের মাথাগোঁজার ঠাই নেই ওদের নিজস্ব কোন ঘর। নেই এখানে তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের কান্নার আওয়াজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এখানে জনসচেতনতার বড়ই অভাব। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে প্রতিদিন জীবনের সাথে সংগ্রাম করেই গতানুগতিকভাবে চলছিল তাদের জীবন। কিন্তু মহামারী করোনায় থমকে গেছে তাদের জীবন জীবীকা।
বলছিলাম, হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নুরপুর ইউনিয়নের সুতাং বাজারের সংলগ্ন আব্দুল্লাহপুর গ্রামবাসীর জীবন-যাপনের নিয়মিত গল্প। এতো সব নেই এর মাঝে তাদের আছে কেবল ভোটের অধিকার। ভোট দিতে পারলেও উপেক্ষিত তাদের নাগরিক সুযোগ সুবিধা।
জানা যায়, স্বাধীনতার আগে কয়েকটি পরিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অস্টগ্রাম থেকে এসে সুতাং বাজারের পাশে এসে বসবাস করা শুরু করে। পরবর্তীতে একাত্তরপরবর্তি আরো কয়েকজন এখানে জীবন-জীবিকার টানে চলে আসেন। ধীরে ধীরে তাদের পরিবার ও মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। এখানে বর্তমানে প্রায় ২৩টি পরিবার বসবাস করছে। এসব পরিবারের বেশিরভাগ পুরুষরাই ধান-চালের বস্তা মাথায় করে গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
এর মাঝে সম্প্রতি একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেরা নানান পেশায়ও জড়িত হয়েছেন। কেউবা চা বিক্রি করেন, কেউবা ঝালমুড়ি। আবার কেউ কেউ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন।
নুরপুর ইউনিয়নের সুরাবই গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে ভোটার হলে ও আব্দুল্লাহপুর নামেই তাদেরকে সবাই মুখে মুখে চিনেন। সারাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ধারণ করায় চলমান লকডাউনে তাদের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ অধ্যায়।সরেজমিনে গিয়ে কথা বললে তারা বিগত দুই মাস ধরে খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করে আসছেন বলে জানান।
এই পাড়ার আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী শিরিন আক্তার জানান, তার ৪ মেয়ে দুই ছেলে। এর মধ্যে এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। বিগত কয়েকবছর ধরে তার মেয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে আসছেন। কিন্তু এই লকডাউনে তিনি তার চায়ের দোকান খুলতে পারেন না। শিরিন আক্তার ও তার স্বামীসহ সুতাং বাজারে চা বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করেন। লকডাউনের কারণে তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।
সুফিয়া বেগমের স্বামী নেই, স্বামী না থাকলে ও বিধবা ভাতা পান না। তার ৩ ছেলে ও এক মেয়ে আছে উনার ছেলে আনোয়ার আগে কাজ করে সংসার চালাত কিন্তু করোনায় সে বেকার হয়ে পড়েছে।
শরিফা বেগম জানান, তার দুই ছেলে দুই মেয়ে আছে। ছোট ছেলে সুজন আগে একটা হোটেলে কাজ করত। কিন্তু লকডাউনের কারণে হোটেলে বেচাকেনা না থাকায় সেও কাজে যায় না। তাদেরও অনেক কষ্টেসৃষ্টে দিন যাচ্ছে।
গ্রামের বয়স্ক মহিলা জেসমিন বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘গত ৪ বছর ধরে আমার একটি মেয়ে প্রতিবন্ধী। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। যেখানে ঠিকমতো তিন বেলা খাবারই যোগাড় করতে পারি না, সেখানে চিকিৎসা তো কেবলই বিলাসিতা। মেয়েটা যদি প্রতিবন্ধী ভাতা পেত তাও কিছুটা উপকার হত।’
এভাবে বলতে গেলে পুরো আব্দুল্লাপুর পাড়াটাই যেন এক হতাশার গল্প। গ্রামের প্রতিটি পরিবারই যেন অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ পাড়ার বেশ কয়েকজন দশ টাকা দরের চাল পেতেন। কিন্তু দশ টাকার চাল বিতরণ বন্ধ থাকায় তারা এখন এ সুবিধা থেকে ও বঞ্চিত রয়েছেন। সামান্য জায়গায় টিনের বেড়ার ঘরে থাকলেও তাদেরকে প্রতি মাসে মাসে ৪০০ টাকা করে ঘরভাড়াও দিতে হয়। সেই সাথে দিতে হয় বিদ্যুৎ বিল। এই মহামারীর সময়ে কোন মাসের ঘরভাড়া মওকুফ করেনি মালিকপক্ষ।
আব্দুল্লাহপুরের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ায় আগ্রহ নেই। বয়সে একটু বড় হলেই কাজে ঠেলে দেন অভিভাবকরা। তাই এসব মানুষের ভাগ্য পাল্টানোরও সুযোগ আসে না। তবে প্রতিবারই নির্বাচন এলে মিটিং মিছিল, পোস্টার লাগানোর কাজের জন্য ওদের কদর বাড়ে।
সুতাং বাজারের ধান ব্যবসায়ী এম এ মামুন আহমেদ জানান, ‘লকডাউনের কারণে তারা অনেক কষ্টে আছে। আর কয়েকমাস যাবত ধানের আমদানি রপ্তানি কম থাকায় আব্দুল্লাহপুরের যারা বস্তা টানার কাজ করতেন তাদেরও এখন কাজ নেই। তাই সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমি তাদেরকে সরকারিভাবে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে নুরপুর ইউনিয়নের সুরাবই গ্রামের ইউপি সদস্য আবুবকর ছিদ্দিক জানান,আমি চেষ্টা করি তাদেরকে সহায়তা করার জন্য। রোযার ঈদে তাদেরকে সহায়তা করেছি। কিন্তু আমার বরাদ্দ সীমিত থাকায় এবার ঈদুল আজহাতে তাদেরকে সহায়তা করতে পারিনি। সামনে বরাদ্দ আসলে তাদেরকে সহায়তা করা হবে।
এ বিষয়ে নুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মুখলিছ মিয়া জানান,আমি প্রতিবারই তাদেরকে সহায়তা করে আসছি। ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ সারা ইউনিয়নেই বন্টন করতে হয়। এবার তারা হয়ত বাদ পড়েছে। পরবর্তীতে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা করা হবে।
এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান,‘ঈদের আগ পর্যন্ত নুরপুর ইউনিয়নে নগদ অর্থসহ প্রচুর পরিমাণ চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখছি। খুব শীঘ্রই তাদেরকে সহায়তা করা হবে বলে জানান।
Leave a Reply