শিশু জুঁই মনির পাশে দাড়িয়েছে এসপি আনোয়ার হোসেন
মো: জাহানুর ইসলাম (দিনাজপুর জেলা) প্রতিনিধি:
ভ্যান চালাচ্ছেন শিশু জুঁই মনি, ভ্যানের এক পাশে বসে আছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাবা, উদ্দেশ্যে সন্তানকে পাহারা দেওয়া অন্ধ বাবার। পেটের দায়ে সংসারের ঘানি টানতে ভ্যান চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে জুঁই মনি।
চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া জীবনের সাথে যুদ্ধ করে সংসারের হাল ধরা জুঁই মনির বয়স ১০ বছর। যে বয়স তার পুতুল খেলার কথা সেসময় তার হাতে ভ্যানের হ্যান্ডেল। পুতুলের মত কোমল দুটো হাতে কড়া পড়ে গেছে মেয়েটার। তারপরও ঠোঁটের ফাঁক গলে হাসির রেখা ফুটে আছে। কি মায়া ভরা মুখ মেয়েটার।
শিশু জুঁইয়ের বাবার নাম নাম জিয়া, মা সাহারা বেগম থাকেন জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের (মধ্যপাড়া পাথর খনি এলাকা) আকন্দ পাড়া গ্রামে। নেই কোন নিজস্ব জমিজমা, যেখানে থাকেন সেটিও বন বিভাগের জায়গা। সেখানে কোনমতে গড়ে তুলেছেন মাথা গোঁজার মত অস্থায়ী একটি বাড়ি।
জন্মগত ভাবেই তার বাবা চোখে কম দেখতেন। গত তিন বছর থেকে আর চোখে দেখেন না বললেই চলে। জুঁই মনিরা চার বোন এক ভাই। ছোট্ট ভাইয়ের বয়স তিন বছর। উপার্জনক্ষম কোন ব্যাক্তি নেই তাদের সংসারে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেঝ বোন অন্যের বাসায় কাজ করে। জুঁই মনি তৃতীয় তার ছোট আরও এক ভাই ও বোন আছে। বনের খড়ি কুড়িয়ে, অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করে কোন মতে দু-বেলা খাবার জোটে তাদের। কখনো এক বেলা খাবার জোটে তো বাকি দু-বেলা জোটেই না। মাঝে মাঝে সকলকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয় অসহায় এই পরিবারটিকে।সমাজসেবা অফিস থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও এত বড় পরিবার চালানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।
পরিবারে রোজগার করার মত উপযুক্ত মানুষ না থাকায় শেষ পর্যন্ত জুঁই মনিই হাল ধরেছে তার পরিবারের। ইচ্ছা করলে খুব সহজেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারতেন তার বাবা। কিন্তু ছোট্ট জুঁই মনি যে ভিক্ষার টাকা ঘরে তুলবে না। তার জেদের কারণেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিন বছর আগে ভ্যান ক্রয় করেন তার মা। প্রথমে প্যাডেলে চালিত ভ্যান ক্রয় করে কিছু দিন চালায় জুঁই। পরে কিছু টাকা খরচ করে ভ্যানটিকে ব্যাটারি চালিত করেন।
প্রতিদিন জুঁই মনি ভ্যানে যাত্রী কিম্বা মালামাল উঠিয়ে ছুটে চলেন পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে। ছোট মেয়ে বলে অনেকেই তার ভ্যানে উঠতে কিম্বা মালামাল দিতে চাইত না। তখন তার বড় হতে ইচ্ছে করতো। সে সবসময় স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবে, বাবার চোখের চিকিৎসা করবে, ছোট দুটি ভাই বোনকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। তার নিজেরও খুব শখ পড়াশুনা করার, ছাত্রীও সে খারাপ নয়। তবে শিশু জুঁই মনির আর বড় হতে ইচ্ছে করে না। কারণ সমাজের কিছু কুৎসিত মানুষের কথা আর কুনজর তাকে তাড়া করে।
কিছুদিন পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুঁই মনির ভ্যান চালানোর দৃশ্য দেখে দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আনোয়ার হোসেন বিপিএম, পিপিএম (বার) এর হৃদয়ে নাড়া দেয়। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছিলেন না। তার যে আর সহ্য হচ্ছে না কখন জুঁই মনির পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন। দেরী না করে তার প্রতিনিধি হিসেবে জেলা পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল পাঠালেন মেয়েটির বাড়ির উদ্দেশ্যে সাথে দিলেন জুঁইয়ের পরিবারের জন্য খাবার আর নগদ টাকা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছিলেন শিশু জুঁইয়ের বাড়িতে প্রতিনিধি দল।
সেখানে আশেপাশে চোখে পড়বার মত তেমন বাড়ি ঘরও নেই। পুলিশের গাড়ি দেখে বাড়ির ভেতর থেকে অর্ধ উলঙ্গ দুটো শিশু বেরিয়ে এল। এই শীতেও তাদের শরীরে বস্ত্রের দেখা মিলল না। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে মিলল একটা চার্জার ভ্যান। আর সেটা নিয়েই বাইরে বের হতে উদ্যত মিষ্টি চেহারার এক শিশু মেয়ে। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন জুঁই মনি। ভ্যানের সামনে বসা জরাজীর্ণ পোশাকের লোকটি তার বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্দী জিয়া। এসময় ১০ বছরের শিশু জুঁই ও তার পরিবারের মুখে উপরোক্ত কথাগুলো শুনে জেলা পুলিশের প্রতিনিধিদল ও প্রতিবেদকগণ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং জুঁইকে দেখে অনেকের চোখ বয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।
এ প্রসঙ্গে দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বিপিএম, পিপিএম (বার) মুঠো ফোনে বলেন, এই ছোট্ট দৃঢ়চেতা মেয়েটার খবর আমরা কেউই জানতাম না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরে এই অসহায় পরিবারটির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি। আমাদের এই ক্ষুদ্র অনুদান হয়তো কিছুই না। কিন্তু, নিশ্চয়ই জুঁই মনিকে টিকে থাকার লড়াইয়ে উৎসাহ দিবে। সে জানবে, সে একা নয়। তবে আমরা সাধ্যমত সবসময় তার পাশে থাকব।
তিনি আরো বলেন, সেখান থেকে প্রতিনিধিদল ফিরে আসার সময় জুঁইকে বলেছিলেন ভ্যান চালাতে কি খুব কষ্ট হয় মা। উদাস দৃষ্টিতে খানিকটা তাকিয়ে থেকে সে বলেছে- "মানুষ হয়ে মানুষ টানার মত কষ্ট আর নাই।" যা শুনে আমার বিবেককে কাঁদিয়ে তুলেছে। তিনি বিত্তবানদের প্রতি সমাজের এসব অসহায় পরিবারগুলোর পাশে থাকবার আহ্বান জানান।