মোঃ আবু সাঈদ
সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি
সুন্দরবনের তীর ঘেষে গড়ে ওঠা জনপদ সাতক্ষীরা। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ও সুন্দরবনের তীর ঘেষে গড়ে ওঠা সাতক্ষীরার সবচেয়ে উপকূলীয় অঞ্চল আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা। সিডর, আইলা, ফনী, বুলবুল, আম্ফান ও ইয়াস ইত্যাদির মতো বড় বড় ঘূর্নিঝড়ের আঘাতে এখানকার অধিবাসীরা সর্বশান্ত হয়ে যায়। আবারো নতুন করে শুরু করে বাঁচার সংগ্রাম। ঠিক তখনই আবার নতুন কোনো ঘূর্নিঝড় এসে সবকিছু নদীর জোয়ারের পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে তাদেরকে নিঃস্ব করে দেয়।
উপকূলবর্তী এই অঞ্চলের মানুষেরা প্রধানত কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কেউ কেউ সুন্দরবনের বাঘের সাথে লড়াই করে জীবিকা অন্বেষনের প্রয়োজনে। হয়তো অনেক পরিবার হারায় তাদের কর্মজীবি লোকটিকে।
কেউ কেউ বা চলে যায় বঙ্গোপসাগরের গহীন জলরাশিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে। সুন্দরবনের বাঘ আর বঙ্গোপসাগরের নানান প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে চলা এ অঞ্চলের মানুষ হেরে যায় সিডর, আইলা, ফনী, মোরা , আম্ফান ও ইয়াসের মতো প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়ের কাছে। বাঁচার প্রয়োজনে তাদেরকে এইভাবেই সংগ্রাম করতে হয়।
এককথায়, উপকূলে জন্ম নেয়া মানে নানা প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করা। এই সংগ্রাম থেকে মুক্তি পায় না উপকূলের শিশুরাও। টেকসই বেঁড়িবাঁধের অভাবে নদীর জোয়ারের পানিতে তাদের ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, আর গবাদিপশু সহ সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তারা বড় হয়।
উপকূলের শিশু শিক্ষার্থীরা দেখছে তাদের বই-খাতা সহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরন নদীর পানির স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা নিরুপায়, এই দৃশ্য শুধু তাদেরকে দেখতে হয়।
আইলা, আম্ফান ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বেঁড়িবাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে বিলীন হয়ে যায় তাদের চাষযোগ্য জমি। দীর্ঘদিন থাকতে হয় পানিবন্দী। মিলে না কোনো প্রতিকার। ফলে উপকূলীয় এলাকার পরিবর্তনগুলোর ওপর নেমে আসে দারিদ্র্যের নির্মম ছাপ। যা সরাসরি প্রভাব ফেলে উপকূলের শিশুদের ওপর। দারিদ্র্যের কারণে যেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে না, সেখানে পড়ালেখার খরচ জোগানো তো অসম্ভব। ফলে আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে উপকূলের শত শত মেধাবী শিক্ষার্থী।
উপকূলের রাস্তা-ঘাটগুলো ভালো না থাকায় ভোগান্তিতে থাকে অত্র এলাকার শিক্ষার্থীরা। বিশেষকরে বর্ষাকালের সময়টাতে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়তে হয় উপকূলের শিক্ষার্থীদের। তাছাড়া বানভাসি শিক্ষার্থীরা তো স্কুলের পথে যেতেই পারে না। এভাবেই নানা প্রতিকূলতার স্বীকার হয়ে বেড়ে ওঠে তারা। তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার উপকূলবর্তী এলাকা প্রতাপনগরের সাকিবুল হাসান নামের এক বানভাসি শিশু আমাদের বলেন, ” আমাগো (আমাদের) এহানে (এখানে) খালি ঝড়ের সময় ভাঙি(ভেঙে) যায়। দু/তিন বছর পরপর পানিতে ডুবতি (ডুবতে) হয়। আমরা স্কুল য্যাত প্যান্নে (যেতে পারে না)। টাকা পয়সার অভাবে অনেক মানুষ খ্যাত(খেতে) পারে না। এম্মায়( এভাবে ) আমরা বড় হই (বেড়ে উঠি)
অবশেষে সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিআকর্ষন করে সাকিবুল বলেন, ” আমরা বানভাসি, আমাদের বাঁচাও। আমরা ভালোভাবে বাঁচতে চাই”।
উপকূলে তাদের এই দুর্ভোগের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন,” আসলে আমাদের এখানে টেকসই বেঁড়িবাঁধের খুব অভাব। যার কারণে বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে খুব সহজেই এখানকার বেঁড়িবাঁধ ভেঙে যায়। তাই আমাদের দাবি থাকবে কর্তৃপক্ষের কাছে যে- ত্রাণ নয়, টেকসই বেঁড়িবাঁধ চাই। আর আমাদের এখানে যদি মানব বসতি রাখতে হয়, তবে টেকসই বাঁধের বিকল্প নাই”।
জরিপে দেখা গেছে, এভাবে প্রতি ৫/১০ বছর পরে এই এলাকার মানুষের পানিতে ডুবতে হয়। ফলে বারবার হীনমন্যতায় ভোগে উপকূলের শিশুরা।
তাদেরকে যদি বাঁচাতে হয়, তবে দ্রুত উপকূলের সব এলাকায় টেকসই বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ উপকূলের শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চায়। তাদের মুখের হাসি তারা ধরে রাখতে চায়।
Leave a Reply