হাকিকুল ইসলাম
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয় এলো ১৬ ডিসেম্বর’৭১।পাকি হায়েনারাদের আত্মসমর্পনের আনুষ্ঠিকতায় সরব উপস্হিতির কারনে বুঝতে পারি নাই কি যেন একটা না পাওয়ার অতৃপ্তি মনের মধ্যে কাজ করছে।টাংগাইল জেলা শত্রু মুক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে অভিযান এবং বিজয়ের পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত খেয়ে না খেয়ে মিরপুর সহ ঢাকার অভ্যন্তরে পাকি হায়েনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমনের মাধ্যমে তাদের মনোবল ভেঙে আত্মসমর্পনে বাধ্য করতে অক্লান্ত পরিশ্রমের কারনেই হয়তো মনের অতৃপ্তিটি বুঝতে পারি নাই।
পাকি হায়েনাদের আত্মসমর্পনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা টাংগাইলে ফিরে এসে আমার কোম্পানীর মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে টাংগাইল ক্লাবে অবস্হান গ্রহন করি।পরিশ্রান্ত থাকলেও রাএে ঘুমাতে পারি নাই। কেবলই মনে হচ্ছিল দেশ স্বাধীন হলো, পতাকা মানচিএ পেলাম, কিন্তু যার ডাকে মুক্তিযোদ্ধা হলাম, যার নির্দেশে জীবন বাঁজি রেখে যুদ্ধ করে প্রিয় জন্ম ভূমি সোনার বাংলা স্বাধীন করলাম, আমাদের সেই প্রান প্রিয় নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকি হায়েনাদের অন্ধকার কারাগারে মৃত্যেুর প্রহর গুনছেন। তাই বঙ্গবন্ধু বিহীন স্বাধীন বাংলায় সারাদিন ব্যাপী বিজয় উল্লাসে মেতে থাকার অপরাধ বোধ মনের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছিল বলে ঘুমাতে পারছিলাম না। বিষয়টিকে কে কোন ভাবে নেবেন জানিনা। তবে বাস্তবতা হলো, বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারন করে বড় হয়েছি, বঙ্গবন্ধু’র নির্দেশেই মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছি এবং ইচ্ছা রয়েছে আজীবন মুজিব আদর্শের একজন সৈনিক হিসাবেই বেঁচে থাকতে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ১০ জানুয়ারী জাতির জনক বংগ বন্ধু তাঁর স্বপ্ন স্বাধের স্বাধীন বাংলায় পদার্পন করলেন। আমি সেদিন বিমান বন্দরে উপস্হিত থেকে মহান স্হপতিকে দু’চোখ ভরে অবলোকন করতে পেরে দীর্ঘ ২৫ দিন যাবৎ মনের মধ্যে বহমান অতৃপ্তি ও মানষিক যন্ত্রনা থেকে মুক্ত হই।
অতপর, ৭২’র থেকে ৭৪’পর্যন্ত প্রতিটি বিজয় দিবসেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র স্নেহের পরশ পেতে সচেষ্ট থেকেছি। আমার সুযোগ ছিল প্রতিটি বিজয় দিবসেই বঙ্গবন্ধু’র সান্নিধ্যে যাওয়ার।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার! দুরভাগ্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর! স্বাধীন বংলার মহান স্হপতি প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিশ্বাস ঘাতক জিয়া মোস্তাক পরাজিত শক্তির সাথে আতাত করে ১৫ আগষ্ট’৭৫ স্বপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশকে “মিনি পাকিস্হানে” রুপান্তর করার ষড়যন্ত্র করে।স্বাধীনতার অমর শ্লোগান “জয়বাংলা”কে নির্বাসনে পাঠিয়ে মানুষ হত্যায় এবং বাঙালিদের বাড়ীঘরে জ্বালাও পোড়াও এ ব্যবহৃত “জিন্দাবাদ” শ্লোগান পুন:প্রবর্তন, বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশ এবং পবিএ সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাত মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করে সম্প্রীতির অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। অধিকন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রোধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে গনতন্ত্রকে হত্যা করে জনগনকে বিচার প্রাপ্তির অধিকার থেকে বন্চিত করা হয়।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ এর পুর্ব পর্যন্ত ৭৫ পরবর্তি বছর গুলিতে বিজয় দিবসের কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কারন, উক্ত অনুষ্ঠান সমুহে দেশ প্রেমের জাগরনি ধ্বনি “জয় বাংলা”কে বাদ দিয়ে পাকি সংস্করনে জিন্দাবাদ, জাতির পিতাকে অস্বীকার করে নিরলজ্জ ভাবে খুনী জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দম্ভোক্তি সহ অসংখ্য মিথ্যা ইতিহাস পাঠ করা হতো।
কিন্তু আল্লাহ’র মেহের বানীতে ১৯৯৬ সালে শত প্রতিকুলতা ও ষড়যন্ত্রের বাঁধা অতিক্রম করে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা জনতার রায় নিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করে কুখ্যাত ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বাংলা ও বাঙালীকে কলংকমুক্ত করার পর ব্যথাতুর ভগ্ন হৃদয়কে হাল্কা করার চেষ্টা করি। তবে খুনি জিয়া -এরশাদ- খালেদা জিয়ার আমলে পুনর্বাসিত পরাজিত শক্তির দোসর আমলারা খোলস পাল্টিয়ে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থেকে যায়।তাঁরা কৌশলে পাকি ধ্যান ধারনা চলমান রাখায় ব্যথিত হই।দু:খিত হই, যখন দেখি, মাননীয় প্রধান মন্ত্রি সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে “জয় বাংলা” উচ্চারন করলেও আজও কোন কোন প্রশাসনিক আমলা বা উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তারা জয় বাংলা শব্দটি উচ্চারনে কুন্ঠা বোধ করেন।
ইদানিং ফেসবুক, ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ায় বা জাতীয় অনুষ্ঠানে বা সুযোগ পেলেই উচ্চ পদস্হ আমলা, তথাকথিত মুজিব সৈনিক বা অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের মুখে স্তাবকতা মুলক বয় বক্তৃতা শুনে যারপর নাই বিশ্মিত হই।কেননা,তারাই তো সেদিন জাতির জনকের লাশ বিধ্বস্ত ৩২ নাম্বারের সিঁড়িতে ফেলে রেখে বিশ্বাস ঘাতক মোস্তাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন বা তাদের মতো অনেকেই সর্বোচ্চ পদে থেকে সেনা বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, বিডিআর বা পুলিশ বাহিনীকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিতে পারেন নাই। অথচ জাতির জনকের জন্ম না হলে তারা ঐ পর্যায়ে যেতে পারতেন না।
*লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসি বীরমুক্তিযোদ্ধা ও কৃষিবিদ