আবীর হাসান স্বাধীন কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।।
একাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক-হানাদারের বুলেটে কুষ্টিয়ায় প্রথম শহীদ হয়েছিল রনি রহমান। দীর্ঘ ৫০ বছর কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে মাত্র নামফলক নিয়ে জরাজীর্ণ কবরস্থানে রংপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী ঘুমিয়ে আছেন। জরাজীর্ণ কবরস্থানে ঘুমিয়ে থাকা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রনি রহমানের জরাজীর্ণ কবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবাসী জয় নেহালের কাছে পাঠালে তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তার সহযোগিতায় টালি পাড়া নিবাসী কামরুল হাসান পলাশ, সাকিব ও এজাজ উচ্ছ্বাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে রনি রহমানের কবর আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আজও ঠাঁই পাননি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। রনির বড় ভাই দেওয়ান মাসুদুর রহমান জানু আজও ছোট ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে ছুটে বেড়ান বিভিন্ন অফিস আদালত ও মানুষের দ্বারে দ্বারে। মৃত্যুর আগে দেশ প্রেমীক ছোট ভাই রনির মূল্যায়ন দেখে যেতে চান তিনি।
একাত্তরে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম শহীদ রনি রহমান। পুরো নাম দেওয়ান মিজানুর রহমান রনি হলেও কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ নামে পরিচিত। ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর রংপুর জেলা শহরের পালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা দেওয়ান মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক। মাতা রহিমা খাতুন গৃহিণী। বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন রনি। একাত্তর সালে ২২ বছরের টগবগে তরুণ রনি রংপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিলেন পরিচিত মুখ। জড়িত ছিলেন ‘শিখা’ সংসদের সাথে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন ও সামাজিক আন্দোলনে রংপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শতাব্দীর আহ্বান’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন ও সত্তরের নির্বাচনের সময় রনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সম্মিলিত ছাত্র সমাজ”।
রংপুর সরকারি কলেজের বিএ’তে অধ্যায়নরত অবস্থায় রনি তার সহপাঠী রুনু, জয়নাল ও পোকাসহ আরও কয়েক বন্ধুকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রংপুর প্রেসক্লাবে (বর্তমান পায়রা চত্বর) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সবাইকে হতভম্ব করে দেন। এই খবর পাকিস্তানি শাসকদের কানে গেলে সরকার রনির নামে পাকিস্থান ভাঙার ষড়যন্ত্র এনে দেশ দ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ফলে রনি গ্রেফতার এড়াতে রংপুর ত্যাগ করে চলে আসেন কুষ্টিয়া শহরে তার বোনের বাসায়। ভাষা সৈনিক নজম উদ্দিন ছিলেন রনির দুলাভাই। কুষ্টিয়াতে এসেও দমে থাকেননি তিনি, কুষ্টিয়ার স্থানীয় সহযোদ্ধা আব্দুল জলিল, শামসুল হাদী, আ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম, মতিউর রহমান মতি ও অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য কুষ্টিয়া প্রবেশ করে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, ওয়ারলেস গেট ও পুলিশ লাইন্সে অবস্থান করে। ২৫ শে মার্চ রাতেই ঢাকাসহ সারাদেশে গণহত্যা চালায় হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চ থেকে কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে। স্বাধীনতাকামী অন্যান্য মানুষের ন্যায় এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি রনি। রাতের অন্ধকারে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগারের তালা ভেঙে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন রনিসহ কয়েকজন। সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে পেট্রোল ও বিস্ফোরক দিয়ে বোমা তৈরি করেন।
২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে সহযোদ্ধা আব্দুল জলিল, শামসুল হাদী, আসম আখতারুজ্জামান মাসুম, মতিউর রহমান মতি ও অন্যান্য সহযোদ্ধাকে নিয়ে রনি বর্তমান সিভিল সার্জন অফিস সংলগ্ন নিজামত উল্লাহ সংসদের ছাদে উঠে সকাল দশটার দিকে পাক হানাদার বাহিনীর গাড়ি এগিয়ে আসতে দেখে রনি বোমা হাতে নিয়ে নিক্ষেপের প্রস্তুতকালে পাক সেনাদের বুলেট এসে তার মাথায় লেগে ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন। পরবর্তীতে তাকে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। ঐ দিন এলাকাবাসী জানলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ রনির নাম। পরে অবশ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও গুরুত্বের সাথে এই খবর প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু তার আত্মত্যাগের যে মূল্যায়ন পাওয়ার কথা ছিল সেটি এখনো পর্যন্ত পাননি শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রনি রহমান। অথচ যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে আজ তারা বর বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। বিচিত্র এই দেশ, যে দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন নেই। অন্যদিকে তার কবর স্থান দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়েছিল। আজ সেই কবরস্থানটি প্রবাসী জয় নেহাল সেটি সংস্কার করে নতুন রুপে রূপদান করেছেন।
প্রবাসী জয় নেহাল তিনি এক বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন মূল্যায়ন নেই। বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যক্তিরা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ক্রয় করে বড় বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। অথচ দেশের জন্য যারা জীবন দিল তাদের কোন মূল্যায়ন নেই। তিনি এটাও বলেন, কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রনি রহমানের কবরস্থানটি দীর্ঘ ৫০ বছর অবহেলা ও অযত্নে পড়েছিল। সরকারিভাবেও এটার কোনো সংস্কার হয়নি ৫০ বছর ধরে। আজ আমি বিদেশের মাটিতে থেকে তার কবরস্থানটি সংস্কার করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
Leave a Reply