ডায়রিয়া কি?
দিনে তিনবার বা তার চেয়ে বেশিবার স্বাভাবিকের চেয়ে পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পানি ও লবণজাতীয় পদার্থ বের হয়ে যায়। শরীরে পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। সময়মতো পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি পূরণ না করলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ডায়রিয়া। প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৭০ কোটি শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষ ২৫ হাজার শিশুর প্রাণ কেড়ে নেয় এই ঘাতকব্যাধি।
ডায়রিয়া সাধারণত তিনধরনের।
১. Acute Watery Diarrohea (একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া): পাতলা পায়খানা ১৪ দিনের কম স্থায়ী হলে এবং পায়খানার সাথে রক্ত না আসলে। এটি বিপজ্জনক নয়।
২. Persistent Diarrohea (পারসিসটেন্ট ডায়রিয়া): পাতলা পায়খানা ১৪ দিনের বেশি স্থায়ী হলে। এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
৩. Dysentery (ডিসেন্ট্রি): রক্তমিশ্রিত পায়খানা। এটি বিপজ্জনক।
সাধারণত বিভিন্ন রোগ জনিত কারণে হয়ে থাকে। যেমন ক্রোন্স ডিজিস, এইচভি, পিত্তথলির অপারেশ, লিভারের ও জিআইটি এর বিভিন্ন রোগে দীর্ঘদিন হতে পারে ডায়রিয়া।
বর্তমানে হাসপাতাল গুলোতে যেসব রোগি ভর্তি হচ্ছে তার বেশীর ভাগ একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া জনিত সমস্যা।
কি কি কারণে একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া হতে পারে?
১) ভাইরাস জনিত – Rotavirus+ Norovirus (পানির মত পায়খানা, বমি ও সাথে জ্বর দেখা যেতে পারে),
Enteric adenovirus+ Astrovirus (পাতলা পায়খানার সাথে পেটে ব্যাথা বা পেট কামড়ানো মুচাড়ানো দেখা দিতে পারে)
২) ব্যাক্টেরিয়া জনিত- Salmonella (পাতলা পায়খানার সাথে জ্বর ও পেট কামড়ানো দেখা যেতে পারে) Campylobacter (পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে), Shigella (পাতলা পায়খানার সাথে মিউকাস যেতে পারে), E.Coli ( পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে এবং খুবই তীব্র পেটে ব্যাথা থাকতে পারে)
৩) প্যারাসাইট জনিত – Entamoeba histolytica (পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত প্রচন্ড পেটে ব্যাথা দেখা যেতে পারে)
আরো অন্যান্য কারণেও ডায়ারিয়া হতে পারে।
ডায়রিয়ার লক্ষণ:
২৪ ঘণ্টায় তিনবার অথবা এর চেয়ে বেশিবার পানিসহ পাতলা পায়খানা হবে, শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, খাবারের রুচি কমে যাবে ইত্যাদি। অনেক সময় ডায়রিয়া শুরুর প্রথম দিকে বমি হয় আবার পরে অনেক ক্ষেত্রে বমি কমে যেতে পারে। জ্বর হতে পারে, তবে সেটা খুব একটা তীব্র হয় না আবার বেশিরভাগ সময় শরীর হালকা গরম থাকতে পারে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয়:
১) শৌচাগার শেষে আমরা অনেকেই শুধু বাম হাত ভাল করে ধৌত করি।
কিন্তু ডানহাত অনেকেই ঠিকমত ওয়াশ করি না। আপনি বাথরুমে যে বদনাটা ডানহাত দিয়ে স্পর্শ করলেন, শৌচাগারের বদনায় ভাইরাস,ব্যাক্টেরিয়া,প্যারাসাইট সবই থাকতে পারে। সুতরাং উভয় হাতে ও সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড রাখার পর পরিস্কার পানি দিয়ে ভাল করে ধৌত করতে হবে।
২) আমাদের দেশের ফলমুললে ব্যাপক পরিমাণ এ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, এসব খেলেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে সকল প্রকার ফলমুল খাওয়ার আগে অবশ্যই কমপক্ষে ৩০মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে রাসায়নিক পদার্থ মুক্ত করে খাওয়া উচিত।
৩) রেস্তোরাঁর খোলা খাবার অত্যধিক মশলা তৈলাক্ত খাবার, এগুলো খাওয়া মাত্রই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।এগুলো বর্জন করুন।
৪) হোটেলের সকল প্রকার সালাত ও লেবু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলো অনেক আগেই কেটে রাখে,বেশির ভাগ ক্ষেত্রে Rotavirus থাকে।
৫) গরম কালে অনেকেই রান্না করে খাবার ফ্রিজাপ করে দুই/তিন দিন পর্যন্ত খেয়ে থাকেন, এটা মোটেও ঠিক নয়। কারণে ফ্রিজে থাকে লট ওফ ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া, বিশেষ করে Rotavirus,
যা আপনাকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত করতে পারে।
৬) কিছু ঔষুধ এন্টারসিড ও ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় সিরাপ যা খাওয়ার সংগে সংগে ডায়রিয়া হতে পারে।তাছাড়া ও অন্যান্য ঔষুধ ডায়রিয়া তৈরি করে।
৭) আধা সিদ্ধ বা হাফ সিদ্ধ খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৮) বিশুদ্ধ পানি পান করুন,প্রয়োজনে পানি কমপক্ষে ৩০মিনিট তাপে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করুন।
ডায়রিয়া হলে কী করণীয়:
ডায়রিয়া হলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতা তীব্র হলে তা বিপদজনক হতে পারে – বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য।
১) শরীর থেকে যতোটা লবণ ও পানি বেরিয়ে যাচ্ছে তা পূরণ করা। এজন্য রোগীকে বারে বারে খাবার স্যালাইনসহ তরল খাবার খাওয়ানো। এছাড়া যে কারণে ডায়রিয়া হয়েছে তার চিকিৎসা করা।
২) যতোবার পাতলা পায়খানা বা বমি হবে ততোবারই সমপরিমাণ খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ান।
৩) রোগীকে স্বাভাবিক ও পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে।
৪) শিশুর ডায়রিয়া হলে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি খাবার স্যালাইন খাওয়ান।
৫) রোগীর বেশি পানিশূন্যতা হলে অথবা খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানোর পরও যদি পানিশূন্যতা না কমে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শিরার মধ্যে (ইন্ট্রাভেনাস) স্যালাইন দিয়ে পানিশূন্যতা পূরণ করতে হয়।
লেখক: ডা. মোঃ সাইফুল আলম। এম.ডি. (রুদেন ইউনিভার্সিটি) মস্কো,রাশিয়া।
Leave a Reply