এবিএম সালেহ উদ্দীন
ছবির প্রতি আমার দুর্বলতা সেই ছোটবেলা থেকে । বাজারে বিক্রির জন্য নানারকমের ছবি টানানো থাকত । সিনেমার নায়ক-নায়িকসহ বিখ্যাত লোকদের ছবি । চাহিদা মোতাবেক বাবা আমাকে এমন অনেক ছবি কিনে দিতেন । তবে কোন সিনেমানায়ক- নায়িকার ছবি নয় । একসময আমি একটি বড় ছবির আবদার করলে তিনি কিনে দিয়েছিলেন । ছবিটি আমি খুউব যত্নসহকারে রেখে দিয়েছিলাম । একবার স্কুল থেকে এসে আমার পড়ার টেবিলে ছবিটি না পেয়ে চেচামেচি শুরু
করে দিলাম । কোনভাবেই সন্ধান পাওয়া
গেল না । ছবিটি না পেয়ে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছি ।
পরের দিন আমার ভাই আমাকে বলল তোর কাছে যে ৫০ টাকার নোট আছে সেটি আমাকে দিলে সেই ছবির সাথে আরও একটি ভাল ছবি দেয়া হবে । ঐ টাকাটা বড় দুলাভাই আমাকে ঈদ উপলক্ষ্যে দিয়েছিলেন ।
আমি রাজি হয়ে গেলাম । ওই টাকার চেয়ে আমার কাছে ছবিটির মূল্য অনেক বেশি ।এখনো মনে আছে,কায়দে আজম- এর ছবিযুক্ত ৫০ টাকার নোটটি ভাইয়াকে দিয়ে দিলাম । সত্যি সে আমাকে দু’টি ছবি দিয়ে দিল ।
আমি আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ছবিটি পেয়ে খুব খুশি । রাগে ক্ষোভে ভাইয়াকে বললাম, তুমি আমার প্রিয় ছবিটি চুরি করে মিথ্যাকথা বলেছিলে ! কেন বলেছিলে তুমি কিচ্ছু জানো না !
শুধু আমার সংগে নয় , মা’র সঙ্গেও মিথ্যে বলেছো । ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল যা ভাগ.! তারপর অনেকদিন আমি ওর সাথে কথা বলিনি ।
উনিশ শো সত্তরের জাতীয় নির্বাচনের সময় চরফ্যাশন কলেজ মাঠে আমার প্রিয় ছবির সেই মহানায়ককে
দেখেছি । আমার বাবা সঙ্গে ইউনিয়নের অনেক মানুষ তার ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন । নদীমার্তৃক ভোলার দক্ষিনান্চলের বড় থানা হচ্ছে চরফ্যাশন । সেই জনসভায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল । এত সহস্ত্র মানুষ দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম । শীতকালের রৌদ্রস্নাত সকালে দীর্ঘ রাস্তা,আইল-আতাল,খাল-বিলের খেত মারিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে পঙ্গপালের মতো ছুটছে মানুষ । প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য জনস্রোত দেখে অবাক-বিস্ময়ে আমিও হেঁটে চলছি বাবার সাথে । কিশোর বেলার সেই স্মৃতির কথা আজীবন মনে থাকবে ।
একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এবং স্বাধীনতার পর রেডিও তে মহানায়কের প্রেরণাবাহি বজ্রকন্ঠ যেন আজও কানে ভাসে ।
তিয়াত্তুরের শেষদিকে ঢাকার লালমাটিয়ায় বোনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পর আমার ভগ্নিপতি মুক্তিযোদ্ধা ডা: মফিজুর রহমান ( লালামাটিয়া বাস্তুহারা সমিতির তৎকালীন সভাপতি) বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সাথে বত্রিশ নব্বরের বাড়িতে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন । সেখানে মহানায়ককে ( কাছে থেকে) দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম । তাঁর সম্মোহনী দৃষ্টির প্রখরতা যেন আজও
চোখে ভাসে ।
দেশ স্বাধীনের পর ঢাকায় আসার পর টিভিতে সম্প্রসারিত মহানায়কের ভাষণ দেখেছি । পাকিস্তান আমলের একেবারে শেষদিকে আমার কিশোরবেলায় যে ছবিটি আমার ছোট্ট রুমে শোভা পাচ্ছিল । বুঝ হবার পর সেই ছবি দেখি বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে ।তিয়াত্তুর- চুয়াত্তুরে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কষ্ট ও দুর্দশা যখন দেশময় চরম অরাজকতার সময়ও বজ্রকন্ঠ নিয়মিত শোনা যেতো ।
সেইসব আগুনঝরা বক্তব্য সকাল- বিকাল- রাত্রিতেও সেই কন্ঠ যেন এখনও কানে বাজে । মনে হতো অচিরেই মানুষের হাহাকার থেমে যাবে । জনদরদী মহানায়ক কখনো গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সত্তা নয় । তিনি এই মাটি ও মাতৃকার সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ । বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে একীভূত এক কিংবদন্তী ।
পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ- নির্যাতনের যে বীজ বাঙালিজীবনে বপন করা হয়েছিল( !) তা থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে তিনি বাতিয়েছিলেন। কিন্তু আশেপাশের দুষ্টচক্র সেসব কার্যকর করতে বিলম্বিত তালিকায় চাপা দিয়ে রাখে । স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনসহ জনকল্যাণমুখি রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন । জেল খেটেছেন ।
বিশ্ব বিখ্যাত বিপ্লবী শিল্পী জর্জ হ্যারিসন এবং বব ডিলানের গানের মতো মহানায়কের সেইসব প্রতিবাদী কন্ঠ সমগ্র মানুষকে জাগিয়েছিল ।
মহানায়কের পক্ষথেকে উনিশশো একাত্তুরের ছাব্বিশে মার্চ আরেক মহান মুক্তিযোদ্ধা ও সেনানায়কের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরবার আহবান জানানো হয়েছিল । তারও আগে ৭ই মার্চ ঢাকার জনসমুদ্রে আমাদের মহানায়ক ঘোষণা দিয়ে
বলেছিলেন -“এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম “। মূলত: সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি স্বাধীনতার আগাম বার্তা ।
২৬শে মার্চের পর থেকে থেকে সমগ্র দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ । কতিপয় স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া সমগ্র দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাকে উদ্দীপ্ত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ।
তিয়াত্তুর ও চুয়াত্তুর মাসটি ছিল মহানায়কের জন্য কঠিণ সময় । একদিকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের হাহাকার অন্যদিকে দলের ভিতর ও বাহিরের সুবিধাভোগী লোকদের চাটুকারবৃত্তি । একদিকে মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদনের প্রত্যয় , অন্যদিকে দলীয় স্বার্থপর চোর- বাটপারদের সামাল দেয়ার চেষ্টা । একদিকে দেশ গড়ার উদ্যোগ ও চেষ্টা অন্যদিকে দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র ।
একদিকে গণতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টা, অন্য গণতন্ত্র হত্যা করবার কূটকৌশল !
পঁচাত্তুরের পনর আগস্ট শিশিরঝরা স্নিগ্ধ ভোরের সূর্যালোকের পরশ যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছিল । এমন সময় ইথারযোগে খবর ছড়িয়ে পড়ল মহানায়কের মহাপ্রয়াণের কথা ।! আমি তখন শৈশবপেরোনো তরুণতম ছাত্র । গজারিয়ার মধ্যবাজারের গদিঘরের পিছনের
রুমে থাকতাম । রেডিওর খবরটি শুনে আমার কচিমন এবং হৃদয়ের ভেতরকার সবকিছু যেন দুমড়ে-মুচড়ে স্তব্ধ ও স্থবির হয়ে গেল ।
জীবনের সকল কঠিণ ও দুর্ভেদ্য পথের নিত্যসহচর সুদৃঢ় মনোভাবের গণমানুষের প্রিয় সেই
সাহসী মানুষটি নেই ?
জীবনের অন্তিমলগ্ন অবধি এই মহানায়ক মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য ব্যপৃত ছিলেন ।গণমানুষের কল্যাণ চিন্তার বাইরে কোন গড্ডালিকায় তিনি গা ভাসিয়ে দেন নি ।
মহানায়কের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর
বড় হতে হতে এ পর্যন্ত আমার অনুভব ও উপলুব্ধিতে যতটুকু বুঝলাম ,আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের ভেতরকার পশুবৃত্তিতে নৃশংসতা ও পাশবিকতার সবকিছুই বিবেকহীনদের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া সম্ভব । এমনকি পৃথিবী ধ্বংস মানবিকতার কবর দিতেও অমানুষদের কাছে অসম্ভব কিছু নয় । আমার চিরকালের পরম শ্রদ্ধাভাজন সেই মহানায়কের নাম
যিনি সৃজনে মননে,অনুভবে বহমান..
তিনি মহানায়ক
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ ।
–লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক ।
Leave a Reply