হাকিকুল ইসলাম খোকন ,যুক্তরাষ্ট্র সিনিয়র প্রতিনিধিঃ
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রেষারেষি নিয়ে এর আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করতে কোনো দ্বিধা করেনি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ।
কিন্তু চলতি সপ্তাহান্তে এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা ছিল খুবই খোলামেলা এবং তির্যক।
সপ্তাহান্তে মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) সাথে এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক এখন ‘পুরোপুরি অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে এবং পুরো বিশ্বের ওপর এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার আগে এই দুই দেশকে এই সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড মহামারি এবং প্রভাব বিস্তারের রেষারেষিতে বিপর্যস্ত বিশ্বের নেতারা যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে একে একে নিউইয়র্কে হাজির হচ্ছেন ঠিক সে সময়ে মিস্টার গুতেরেজ এ সতর্কবাণী দিলেন।
গুতেরেজ বলেন, ‘মানবাধিকার, অর্থনীতি, সাইবার নিরাপত্তা এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সার্বভৌমত্ব’ নিয়ে যতই রাজনৈতিক মনোমালিন্য থাকুক না কেন বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিকে অবশ্যই জলবায়ু, ব্যবসা এবং প্রযুক্তি নিয়ে সহযোগিতার পথ ধরতে হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিডের টিকা এবং আরো বেশ কিছু বৈশ্বিক সঙ্কটের’ গেরো খুলতে এই দুই পরাশক্তিকে নিজেদের মধ্যে মধ্যে কার্যকর একটি সম্পর্ক তৈরি করতেই হবে।
কিন্তু, তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা এখন শুধু বিরোধ দেখতে পাচ্ছি।’
চীন-মার্কিন রেষারেষি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব তার এই উদ্বেগ এবং ক্ষোভ এমন সময় প্রকাশ করলেন যখন জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর উপায় নিয়ে নতুন বোঝাপড়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আরেকটি সম্মেলনের আর দেড় মাসও সময় নেই। এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর লক্ষ্যে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে নভেম্বরের আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনের সাফল্য, ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বোঝাপড়ার ওপর।
‘এই পৃথিবীর পরিণতি কী হবে তা এখন প্রধানত নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ওপর। ভালো-মন্দ সবকিছুর মূলেই এখন এই দুই দেশ। আমরা ভীষণভাবে আশা করি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রেষারেষি থেকে যেন জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুকে তারা বাইরে রাখে’, বিবিসিকে বলেন জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ড. সালিমুল হক।
দূষণের প্রধান দুই হোতা
শুধু অর্থনীতি বা সামরিক শক্তির বিবেচনাতেই নয়, পরিবেশে কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে এই দুটো দেশ এক এবং দুই নম্বরে।
২০১৯ সালে চীনের কল-কারখানা থেকে এক কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবেশে ছড়িয়েছে বলে হিসাব দিয়েছে পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট ট্রেড। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ছড়িয়েছে ৫৪ লাখ টন ক্ষতিকারক গ্যাস।
সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট নিরসন নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য, বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এ নিয়ে নিজেরা কতটা কথা বলছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র? ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে নিজেদের রেষারেষি থেকে পরিবেশ রক্ষাকে কতটা আলাদা রাখছে?
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দিলে আশান্বিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।
গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনের আগে নিজের মধ্যে বোঝাপড়া করতে এ মাসের শুরুতে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, যিনি বর্তমানে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত হিসাবে কাজ করছেন, চীনে গিয়েছিলেন। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে কেরির সাথে বৈঠক হয় জলবায়ু বিষয়ে চীনের প্রধান কর্মকর্তা শি জেনহুয়ার সাথে।
ওই বৈঠকে বোঝাপড়া বিশেষ কিছু হয়নি বলে জোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
জন কেরির ব্যর্থ সফর?
লন্ডনের নির্ভরযোগ্য দৈনিক ফাইনানশিয়াল টাইমস তাদের ২ সেপ্টেম্বরের সংস্করণে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলছে, তিয়ানজিনের বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে এই বলে যে, চীনকে নিয়ে তাদের ‘ভুল কৌশলগত সমীকরণ’ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে এবং এর পরিণতিতে জলবায়ু নিয়ে দুই পক্ষের বোঝাপড়া ‘ঝুঁকিতে পড়েছে’।
তিয়ানজিনের বৈঠকের আগের দিন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক ভিডিও বৈঠকে জন কেরিকে খোলাখুলি বলেন ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালো না থাকলে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সহযোগিতা টেকানো কঠিন হবে।’ ওয়াংকে উদ্ধৃত করে মিডিয়াতে খবর হয়েছে যে, চীনা মন্ত্রী জন কেরিকে বলেছেন, ‘বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে।’
হংকং থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট তাদের ৩ সেপ্টেম্বরের এক রিপোর্টে বলছে তিয়ানজিনে জলবায়ু নিয়ে জন কেরির সাথে চীনা কর্মকর্তাদের বৈঠকে কোনো বোঝাপড়া হয়নি।
চীনে মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে বিতর্কের জেরে ওই বৈঠকে জলবায়ু নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি বলে পত্রিকাটি বলছে।
সম্প্রতি চীনের সোলার বিদ্যুৎ শিল্পে উইগুর মুসলিমদের জোর করে কাজ করানো হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে এবং শিনজিয়াং প্রদেশে তৈরি এসব সোলার বিদ্যুৎ প্যানেলের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা করেছে তারা, যা নিয়ে চীনারা চরম ক্ষুদ্ধ।
জন কেরির চীন সফরের কোনো ফলাফল না হওয়ার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ আন্দোলনের শীর্ষ সংস্থা গ্রিন পিসের কর্মকর্তা লি শুও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, ‘এই সম্পর্কই (চীন-যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বের জন্য দুর্গতি বয়ে আনছে।’
‘নেতৃত্ব নিতে উন্মুখ চীন’
তবে ডঃ সালিমুল হক ততটা হতাশ নন। তিনি বলেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র দুদেশই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি ভোগ করছে এবং তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এ ব্যাপারে অগ্রণী হবে বলে তিনি মনে করেন।
‘সম্প্রতি বন্যায় দুই দেশেরই পাতাল রেলে পানি ঢুকেছে। নিউইয়র্কের মত শহরে বন্যায় মানুষ মারা গেছে। আমি বিশ্বাস করি অন্যের জন্য না হলেও নিজেদের স্বার্থেই যে তাদেরকে পৃথিবীকে বাঁচানোর কাজে ভূমিকা রাখতে হবে এই উপলব্ধি এই দুই দেশের হয়েছে।’
তাছাড়া, ডঃ হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে যত টানাপড়েনই থাকুক না কেন চীন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের দেশকে কতটা হুমকিতে ফেলছে তা নিয়ে চীনা বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ব্যাপক এক গবেষণা করে তার রিপোর্ট সরকারকে দিয়েছে।
‘চীন ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে যে বিশ্ব অর্থনীতিকে জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর ভর করতে হবে। চীন এ ব্যাপারে নেতৃত্ব নিতে উন্মুখ এবং আমাদের ভরসা সেটাই,’ বলেন ডঃ সালিমুল হক।
Leave a Reply